সর্বশেষ

» শিশুসন্তানকে বুকে জড়িয়ে নবীজি বললেন, ‘নিজেকে ধরে রাখতে পারছি না’

প্রকাশিত: ২৭. জুলাই. ২০২৫ | রবিবার

নিউজ ডেস্ক ::: রাসুলুল্লাহ (সা.) তখন মদিনায়। তাঁর চার মেয়ের মধ্যে শুধু ফাতেমা (রা.) বেঁচে আছেন। বাকি তিনজনকে নিজ হাতে কবর দিয়েছেন জান্নাতুল বাকিতে। এর মধ্যে ফাতেমার বিয়ে হয়েছে। নবীজি নানা হয়েছেন। সকল ব্যস্ততার মধ্যেও তিনি নাতিদের সঙ্গে সময় কাটান। ফাতেমা (রা.)-এর বয়স তখন ২০ বছর। তখন নবিপত্নী মারিয়া কিবতিয়া (রা.)-এর কোল আলো করে জন্ম হয় এক পুত্রসন্তানের। নবীজির হৃদয়জুড়ে বয়ে চলে আনন্দের জোয়ার।

প্রথমবারের মতো ইসলামের সব আনুষ্ঠানিকতা তিনি পূর্ণ করেছিলেন এই সন্তানকে ঘিরে। তাঁর আনন্দটা একবার চিন্তা করে দেখুন। ইসলামের আবির্ভাবের পরে জীবনে এই প্রথম নিজের পুত্রসন্তানকে কোলে নিয়ে আজান দিতে সক্ষম হলেন তিনি। অন্য অনেকের সন্তানের তাহনিক (মুখে খেজুর ঘষে দেওয়া) করার পর এবার এলো নিজ সন্তানের তাহনিক করার সুবর্ণ সুযোগ। অন্যের সন্তানের আকিকা করার পর, এবার তিনি নিজ পুত্রসন্তানের আকিকা করলেন। নাম রাখলেন। সগর্বে নিজ সন্তান ইবরাহিমকে কোলে নিয়ে বলেন, ‘তোমরা দেখো, আল্লাহ তোমাদের নবীকে এক পুত্রসন্তান দান করেছেন, আমি আমার পিতার নামে তার নাম রেখেছি ইবরাহিম।’

এই সন্তানের প্রতি ছিল তাঁর বিশেষ অনুরাগ। শিশুটি ধাত্রীর কাছে থাকা অবস্থায় প্রতিদিনই দেখতে যেতেন। স্ত্রীদের ঘরে সাক্ষাতে যাওয়ার সময় সঙ্গে করে নিয়ে যেতেন শিশু ইবরাহিমকে। মাঝে মাঝে তাঁকে মসজিদেও নিয়ে আসতেন।

ইবরাহিমের বয়স তখন ১৬ মাস। সন্তানের সঙ্গে রাসুল (সা.)-এর গভীর সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। এরই মধ্যে একদিন অসুস্থ হয়ে পড়ে কলিজার ধন। একমাত্র পুত্রের অসুস্থতায় যারপরনাই অস্থির হয়ে পড়েন নবীজি। সেদিনের ঘটনার বিবরণ পাওয়া যায় আনাস ইবনে মালেক (রা.)-এর জবানিতে। তিনি বলেন, ধাত্রীর দূত এসে রাসুল (সা.)-কে বলল, ‘হে রাসুলুল্লাহ, ইবরাহিমের ভীষণ অসুখ, মনে হচ্ছে সে মারা যাচ্ছে।’ এমন খবর শুনে কাজ ফেলে সাহাবিদের সঙ্গে ধাত্রীর বাসায় ছুটে গেলেন নবীজি।

ধাত্রীর স্বামীর নাম ছিল আবু সাইফ। পেশায় সে একজন কামার। রাসুল (সা.) যথারীতি তার কাছে ঘরে প্রবেশের অনুমতি চাইলেন। তিনি তাকে কোলে নিয়ে চুমু খেলেন এবং তার চুলের ঘ্রাণ নিলেন। ইবরাহিম জোরে জোরে এবং ধীরে ধীরে নিশ্বাস নিচ্ছে। আনাস (রা.) বলেন, রাসুল (সা.)-এর বাহুতেই তাঁর সন্তানের প্রাণ চলে গেল।

রাসুল (সা.) ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলেন। আবদুর রহমান ইবনে আউফ (রা.) নবীজির দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আপনিও হে রাসুলুল্লাহ?’ তিনি নিষ্ঠুরভাবে তা বলেননি। বলেছিলেন গভীর সহানুভূতি নিয়ে, ‘হে রাসুলুল্লাহ, আপনিও কাঁদছেন?’

রাসুল (সা.) তাঁর মৃত সন্তানকে তাঁর বাহুতে আগলে রেখে বলেছিলেন, ‘হে ইবনে আউফ, এটা আল্লাহর দয়া; যা তিনিই আমার অন্তরে দিয়েছেন। আমি নিজেকে ধরে রাখতে পারছি না। এই সন্তানকে আমি অনেক ভালোবাসি।’

আনাস (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) আরও বেশি কাঁদতে লাগলেন। আমরা একদৃষ্টে তাঁর দিকে তাকিয়ে আছি।

রাসুল (সা.) তখন বললেন, চোখ দিয়ে অশ্রু ঝরছে, হৃদয় ব্যথায় ভারাক্রান্ত, তারপরও আমাদের পালনকর্তার খুশি ছাড়া আমরা কিছুই বলব না। আর তোমার মৃত্যুতে আমরা দুঃখিত হে ইবরাহিম, তোমার চলে যাওয়ায় আমরা দুঃখিত! (সহিহ বুখারি, হাদিস: ১৩০৩)

নবীজি তার গোসলের ব্যবস্থা করলেন। শুভ্র কাফনে মুড়িয়ে দিলেন। জানাজার ইমামতি করলেন। নিজ হাতে কবরে শুইয়ে দিলেন বুকের মানিককে।

আপনি বেঁচে আছেন, আপনার সন্তানও মারা যেতে পারে। পিতার জীবনে সন্তানের মৃত্যুর চেয়ে ভারী বোঝা আর কী হতে পারে। সন্তানের মৃত্যুতে আপনি যদি দুঃখ পান, জেনে রাখুন, আপনার নবি মুহাম্মাদ (সা.)-ও দুঃখ পেয়েছিলেন। আপনার হৃদয় ভেঙে অঝোরে কান্না আসছে? জেনে রাখুন, নবিজিও কেঁদেছেন। তবে তিনি তাঁর জীবনের সবচেয়ে কঠিন মুহূর্তেও ধৈর্যধারণের নজির রেখে গেছেন।

রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যার তিন সন্তান অপ্রাপ্তবয়স্ক অবস্থায় মৃত্যুবরণ করে, আল্লাহ তাআলা সন্তানদের ওপর স্বীয় রহমতের কারণে তাকে অবশ্যই জান্নাতে প্রবেশ করাবেন। তিনি বলেন, সন্তানদের বলা হবে, তোমরা জান্নাতে প্রবেশ করো। তখন তারা বলবে, আমাদের মাতা-পিতা জান্নাতে প্রবেশ না করা পর্যন্ত আমরা জান্নাতে প্রবেশ করব না। তখন তাদের বলা হবে, তোমরা এবং তোমাদের মাতা-পিতাসহ জান্নাতে প্রবেশ করো।’ (সুনানে নাসায়ি, হাদিস : ১৮৭৬)

 

আবু হাসসান (রহ.) বলেন, আমি আবু হুরায়রা (রা.)-কে বললাম, ‘আমার দুটি সন্তান মারা গেছে। আপনি কি রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর থেকে এমন একটি হাদিস বর্ণনা করবেন, যাতে আমরা অন্তরে সান্ত্বনা পেতে পারি? তখন আবু হুরায়রা (রা.) বললেন, হ্যাঁ, আমি নবিজিকে বলতে শুনেছি, ছোটো বয়সে মৃত্যুবরণকারী সন্তানেরা জান্নাতের প্রজাপতির মতো। তাদের কেউ যখন পিতা কিংবা পিতা-মাতা উভয়ের সঙ্গে মিলিত হবে, তখন তার পরিধানের কাপড় কিংবা হাত ধরবে, যেভাবে এখন আমি তোমার কাপড়ের আঁচল ধরেছি। এরপর সেই কাপড় কিংবা হাত আর ছাড়বে না, যতক্ষণ পর্যন্ত আল্লাহ তাআলা তাকে তার আম্মা-আব্বাসহ জান্নাতে প্রবেশ না করাবেন।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ৬৩৭০)

উল্লেখ্য, লেখাটিতে আমেরিকা মুসলিম পণ্ডিত, লেখক ও বক্তা ড. উমর সুলাইমানের একটি লেখা থেকে সহযোগিতা নেওয়া হয়েছে।